হোমায়েদ ইসহাক মুন
পাহাড়ে ভোর হওয়াটা অনেক সুন্দর হয়। ঘুম
থেকে উঠেই ত্রিপুরা পাড়ার উঁচু বাঁশের ঘর থেকে তাকালাম আর নয়ন জুড়ালাম।
সবুজের সাথে পাহাড়ের আর পাহাড়ের সাথে মেঘের খুনসুটি চলে অনেকক্ষণ। এরপর
আস্তে আস্তে হালকা আলো পড়তে শুরু করেছে ঐ দূর পাহাড়ের গায়ে। মেঘগুলো তখন
এদিক সেদিক ছুটে চলেছে। তৈনখাল নদীতে পানি মনে হয় কাল থেকে কিছুটা বেড়েছে।
এরমধ্যে শাহীন ভাইও উঠে পড়েছে, আমরা পাহাড়ে গেলে সকালবেলাটা একটু উপভোগ
করার চেষ্টা করি। অন্যরা অবশ্য ঘুমায়। মাঝে-মাঝে ভাল ছবি তোলার নেশাও কাজ
করে। তবে এবারে একটু ব্যতিক্রম হলো। আমি ব্যাগ, ক্যামেরা সব কিছু রেখেই
সুহৃদদের সাথে ভালবাসার টানে ছুটে এসেছি। একটা রেকর্ডই করে ফেললাম, বাস
কাউন্টারে এগিয়ে দিতে গিয়ে এক কাপড়ে চলে এলাম সোজা আলিকদম। আমাদের দল
বিটিইএফ (বাংলাদেশ ট্যুরিজম এক্সপানসন ফোরাম) এর এবারের যাত্রা আলিকদম থেকে
নৌকা করে তাংখই ঝিরি। আমরা ঈদের পরের দিন রাতে রওনা দিলাম ঈগল বাসে, ঈগল
পাখির মত উড়ে উড়ে। গিয়ে নামলাম চকরিয়া তারপর চাঁন্দের গাড়ি। একেবারে ছাদে
গিয়ে উঠলাম। আলিকদম থেকে বাজার হলো আলু, পেঁয়াজ, তেল, নুন। এরপর নৌকাতে চড়ে
বসা। আমাদের গাইড হলো মংচানো মারমা আর জোহন ত্রিপুরা। জোহনকে তো আমরা পরে
জন নামেই ডাকা শুরু করলাম। আলিকদমের মাতামুহূরি নদী ধরে আমাদের ভটভটি নৌকা
সাঁতার কেটে যাচ্ছে। পানির পরিমাণ বেশ হয়েছে এবারের বৃষ্টিতে। এখন শরৎ কাল,
তাই আকাশটাও দেখার মত। মন প্রাণ সব জুড়িয়ে যায়। যতবারই এসব জায়গায় আসি
মনটা কেমন ভরে যায়, নতুন কোন জায়গা মনে হয়। এসব জায়গায় বৃষ্টিতে ভিজতেও
অনেক আনন্দ, মনে হয় সারাদিন ভিজি, তারপরও ভিজি। রোমান্টিকতার পুরোটাই যেন
এখানকার মাটি-পানি- সবুজে-পাহাড়ে মিশে আছে। আমরা সত্যিই হারিয়ে যাই তার
মধ্যে। বৃষ্টিতে ভেজার জন্য নৌকার বাইরে চলে এলাম আর দু’পাশের প্রকৃতিকে
খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করলাম, পানির ফোটাগুলো যখন বহমান নদীতে টুপটাপ
করে পড়ে তখন গায়ে শিহরণ জাগে। তাদের ধরতে ইচ্ছে হয়। আপনাতেই হাত পানিতে চলে
যায়। আমরা নদীর এবাঁক ওবাঁক ঘুরে দোছরি বাজারে চলে এলাম। ছোট্ট একটা বাজার
কিন্তু তাতে দম আছে।
রবিবার হাটের দিন, দূর দূরান্ত থেকে
মানুষজন আসে পাহাড়ের কলা, মরিচ, সবজি আর নানা প্রকার ফল নিয়ে। নারী-পুরুষে
তাতে ভেদাভেদ নেই, পাহাড়ের সকলেই কাজ করে, আমাদের মত না। আরো একটু এগিয়ে
গেলে হাজিরাম ত্রিপুরা পাড়া। যেখানে আমরা প্রথম রাত কাটাবো।
পাড়াটা বেশ উঁচু তবে তেমন একটা সুবিধের না। ত্রিপুরাদের পাড়ায় এর আগে থেকেছি কিনা মনে পড়ে না। তবে সবচেয়ে সুন্দর বমদের পাড়া, পরিষ্কার আর পরিপাটি। আমরা কারবারি হাজিরাম ত্রিপুরার বাড়িতে উঠলাম। পাহাড়ে কারবারিদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে পাড়ার নামকরণ করা হয়। রাতে খিচুড়ি রান্না হলো সঙ্গে আলু ডিম। এবারে বড় বাবুর্চি ইমরান ভাই। যা স্বাদ হয়েছিল তা আর বলতে!!
পাড়াটা বেশ উঁচু তবে তেমন একটা সুবিধের না। ত্রিপুরাদের পাড়ায় এর আগে থেকেছি কিনা মনে পড়ে না। তবে সবচেয়ে সুন্দর বমদের পাড়া, পরিষ্কার আর পরিপাটি। আমরা কারবারি হাজিরাম ত্রিপুরার বাড়িতে উঠলাম। পাহাড়ে কারবারিদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে পাড়ার নামকরণ করা হয়। রাতে খিচুড়ি রান্না হলো সঙ্গে আলু ডিম। এবারে বড় বাবুর্চি ইমরান ভাই। যা স্বাদ হয়েছিল তা আর বলতে!!
পাহাড়ের ভোরটা সত্যিই খুব সুন্দর ছিল। আমি
আর শাহিন ভাই অনেকখানি হেটে আসলাম আর ফেলে আসা বন্ধুদের কথা আওড়াচ্ছিলাম।
সকালে নুডুলস এর পর্ব। আমরা গতকাল নৌকা ছেড়ে দিয়েছি তাই এখান থেকে ট্রেকিং
এর জন্য প্রস্তুত হই। তার আগে বোতল ভরে পানি নিতে হবে। পাহাড়ে চড়তে গেলে এর
কোন বিকল্প নেই। জন জানালো তাংখই ঝিরি আসলে এখান থেকে বেশি দূরে না। আমরা
হাঁটতে শুরু করলাম, একটু হাঁটতেই কিয়াং ঘর, মানে তাদের প্রার্থনার ঘর চোখে
পড়লো। এর কাছেই পেয়ারা বাগান, আমরা বাগানের মালিক থেকে অনেকগুলো টসটসে আর
পাকা পেয়ারা কিনে নিলাম। তারপর আবার হাঁটা। পা চলতে চলতে এক জায়গায় এসে
থেমে গেলো। সামনে একটা বড় ঝিরি, তাতে তো অনেক পানি, নৌকাও সঙ্গে নেই। এখন
কি করা! আমাদের পোলটা সুদ্ধ গলা পানিতে নামতে হলো। এমন করে
একবার-দুইবার-তিনবার। সঙ্গে গোসলও হয়ে গেল। বরইতলী পাড়ার পরে ঝিরিটা সত্যিই
একটু কঠিন হলো। পাথুরে আর পিচ্ছিল সঙ্গে পানির স্রোত, পা ফসকালেই সব কিছু
নিয়ে ভেসে যেতে হবে। বেচারা মামুন ভাইয়ের নতুন ক্যামেরাটা ডুব খেল
একবার-দুইবার। আমরা সাবধানে পার হলাম। এই পথটা পার করলেই তাংখই ঝিরি। কি
অসহ্য! বলে বোঝনো যাবে না। অনেকগুলো স্রোতধারার যেন মিলন মেলা। কেমন যেন
মায়াভরা। শুধু কাছে ডাকে, ইন্দ্রজালে টেনে নিয়ে যেতে চায়। আমরা স্রোতে
আমাদের গা ভাসাই। প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার এইতো মোক্ষম সময়। হাজিরাম পাড়া
থেকে হাড়িপাতিল আনা হয়েছে, সবাইকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে ইমরান। শাহিন ভাই
আলু ধোয়, রাজু ভাই আলু কাটে, আমি পেঁয়াজ কাটি, কেউ পাতিল ধোয়। পিকনিক
পার্টির একটা ভাব উদয় হলো। চালে ডালে খিচুড়ি, আহা কি শান্তি!! আমরা আবার
জলে ভাসি, জলকেলি করি। বিশ্রাম করি আবার জলে নামি। ঝর্ণার অবিরাম ধারা
ফুরাবে না, এত পানি কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে! ঢাকা শহরে পানির হাহাকার দেখলে
মনে হয় এই ধারার কিছুটা যদি ওখানে ঐ মানুষগুলোকে দেওয়া যেত। জলের শব্দ,
পাখির ডাক, বাতাসে হেলেদুলে গাছের শব্দ সবকিছুকে ছাপিয়ে সন্ধ্যে হয়। আকাশে
অজস্র-আসংখ্য তারা মিটমিট করছিল যখন আমরা উঁচু পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে
ছিলাম। তারাদের খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, “আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেব, তুমি
আমার।”
ঝর্ণার কাছেই ছোট্ট একটা জায়গা পেয়ে যাই
তাবু ফেলার জন্য। তারপর অজস্র তারাকে বন্ধু বানিয়ে শুয়ে পড়ি। ভোরে চোখ মেলে
কি সুন্দর একটা দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য! চোখের সামনে ঝর্ণা, পাখিরা ডাকছে
অবিরাম। আমরা ঠিক করলাম ঝর্ণার উপরের অংশে কোনভাবে যাওয়া যায় কিনা। হাজিরাম
আমাদের রাস্তা দেখালো উপরে ওঠার। তবে সবাই গেল না উপরে, আমি, মাহি, জনি,
শাহীন আর রবিন ভাইরা। তেমন একটা কঠিন পথ না। তবে ওঠার পর ঝর্ণার পানি
আমাদের কেমন যেন মোহাচ্ছন্ন করে ফেলল। ঝিরিগুলো একেকটা বাঁক খায় আর মনে হয়
আরো সুন্দর দেখাচ্ছে, আরো একটু গেলে আরো একটু সুন্দর, মনে হচ্ছে কোন মায়ার
জালে আটকে গেলাম। এখান থেকে বের হওয়া বেশ কষ্টের। শাহীন ভাই বলে উঠলো, এতো
‘মায়া ঝিরি’। আমরা এবার বড় ঝর্ণাটার মুখের কাছে চলতে থাকলাম। পিচ্ছিল পথ,
ঝড়ে বড় বড় গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। সেগুলো ডিঙ্গিয়ে আমরা পথ ধরলাম।
পাহাড় পাথরের খাজ ধরে চলে গেছে ঝিরিগুলো, কোথাও হাটুপানি আবার কোথাও গলা
সমান। আমরা একটা জায়গাতে বাদুরের গুহার মত সাতরে পার হলাম। তারপর সেই বড়
ঝর্ণাটার কাছে আসলাম, কিন্তু এর কাছাকাছি যাওয়া যাবে না। বড় বড় দুটো পাথুরে
বেসিন আছে যাতে সবসময় পানি পড়ছে। ম্যান ভারসেজ ওয়াইল্ড হতে পারলে সব কিছু
পার করে যাওয়া যেত। আমরা ব্যর্থ মনোরথে ফেরত আসি। সময় হয়েছে, আমাদের ফিরতে
হবে। নিচে সবাই অপেক্ষা করছে। আমরা নিচে নেমে সব গুছিয়ে আবার ফিরতি পথে
রওনা হলাম। সঙ্গে করে রেখে দিলাম অপূর্ণ কিছু স্মৃতি যেন আবার ফিরে যেতে
পারি।
সূত্রঃ Deshe Bideshe
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন