বদলে যাচ্ছে গাড়ির প্রযুক্তি। ইএফআই থেকে ভিভিটিআই হয়ে এখন নতুন নতুন হাইব্রিড প্রযুক্তির সংযুক্তি ঘটছে। বিশ্ববাজারে ইলেকট্রিক গাড়ির প্রতিও তৈরি হচ্ছে ক্রেজ। গাড়িতে যুক্ত হতে যাওয়া নতুন নতুন সব প্রযুক্তি নিয়ে লিখেছেন মিজানুর রহমান
নতুন শতাব্দীর শুরু থেকেই টেকপাড়ায় যেন উদ্ভাবনের হিড়িক পড়ে। মোবাইল হয়ে গেল স্মার্টফোন।
আর ডিভাইসটি এখন মানুষের অনেক কাজ করে দিচ্ছে সহজে। এদিকে
ইন্টারনেটের গতি বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। যুক্ত হচ্ছে স্মার্ট মানুষের জন্য
নিত্যপ্রয়োজনীয় সব প্রযুক্তি। তবে গড়নে পরিবর্তন ও দৃষ্টিনন্দন হওয়া ছাড়া
প্রযুক্তির খুব একটা প্রভাব পড়েনি যানবাহনে। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে
প্রাইভেট কারে। ধন্যবাদ নতুন নতুন সব উদ্ভাবন, ইলেকট্রিক কার, ‘স্মার্ট
কার’ ধারণাকে, যা দেরিতে হলেও ব্যক্তিগত যানবাহনকে দিচ্ছে ভিন্ন মাত্রা।
আজ আমরা যে ধরনের কার দেখছি আসন্ন কয়েক দশকের মধ্যে সেটি আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে।
গাড়িতে যুক্ত হচ্ছে কম্পিউটারের বিভিন্ন সুবিধা, ব্লুটুথ, ইনফ্রারেড, ওয়াই-ফাই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। লক্ষ্যটা এবার পরিষ্কার।
গাড়িকে করতে হবে স্বয়ংক্রিয়। চলুন দেখে নেওয়া যাক নতুন শতাব্দীর নতুন নতুন সব প্রযুক্তি, যা বদলে দেবে আমাদের পরিচিত প্রাইভেট কারকে।
ভিটুভি কমিউনিকেশন
ভিটুভি কমিউনিকেশনকে ভেঙে বললে হয় ‘ভেহিকল টু ভেহিকেল কমিউনিকেশন’। সহজ
ভাষায় বলতে গেলে এই প্রযুক্তিতে এক গাড়ির সঙ্গে আরেক গাড়ি যোগাযোগ স্থাপন
করবে।
রাস্তায় বের হলে এখন যেমন এক ড্রাইভার আরেকজনকে সাইড দেওয়ার জন্য
চিৎকার-চেঁচামেচি করেন, সেটি আর থাকবে না। এটি যে শুধু ভিটুভিই তা নয়।
এটি হতে পারে ভেহিকল টু ইনফ্রাস্ট্রাকচারও। অর্থাৎ একটি গাড়ি শুধু সামনের
বা পেছনের গাড়ির সঙ্গেই যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হবে না, বরং যোগাযোগ
করতে পারবে রাস্তার যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থাপন করা বিভিন্ন ডিভাইসের
সঙ্গেও। যেমন—ট্রাফিক লাইট। অর্থাৎ ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার দিন একেবারেই
শেষ হতে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তি সাধারণত ইনফ্রারেড দিয়ে চালানো হচ্ছে।
মার্সিডিজের ই-ক্লাস গাড়িগুলোতে এর মধ্যেই এই প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে।
ইলেকট্রনিকস ফুয়েল ইনজেকশন (ইএফআই)
ইঞ্জিনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এসেছে এই প্রযুক্তি। ইঞ্জিনের মধ্যে
কতখানি জ্বালানি যাবে বা কতখানি অক্সিজেন এর সঙ্গে মেশালে আরো অনেক বেশি
দক্ষতা পাওয়া যাবে, সেটি নির্ণয় করাই এই প্রযুক্তির কাজ। সেন্সরের মাধ্যমে
এটি জ্বালানির সম্পর্কে নানা তথ্য ইঞ্জিন কন্ট্রোল ইউনিটে পাঠায়।
বিশেষভাবে তৈরি কম্পিউটার সিস্টেম পরে নিয়ন্ত্রিতভাবে ইঞ্জিনে জ্বালানি
প্রেরণ করে।
ব্লুটুথ কানেক্টিভিটি
ব্লুটুথ কানেক্টিভিটি প্রযুক্তি বর্তমানে অনেক গাড়িতেই আছে। তবে এই
প্রযুক্তির সাহায্যে গাড়ির নিরাপত্তা আরো বাড়ানো যেতে পারে বলে ধারণা করছে
অনেক কম্পানি। এর মাধ্যমে গাড়ির চাবিকেই নাকি বাতিল করে দেওয়া সক্ষম।
অর্থাৎ গাড়ির একটি অ্যাপ আপনার ফোনে থাকবে আর আপনি ব্লুটুথের সাহায্যে
সংযুক্ত থাকবেন গাড়ির সঙ্গে। হয়ে গেল। গাড়ি আনলক থেকে শুরু করে জ্বালানি
কতটুকু আছে, কত বেগে যাচ্ছেন—সব তথ্য চলে আসবে আপনার মোবাইলে। চলতি বছরেই
ভলভো তার নতুন গাড়িগুলোতে এই প্রযুক্তি চালু করবে।
তারহীন চার্জিং ও ওয়াই-ফাই
নতুন গাড়িগুলোতে যুক্ত হচ্ছে ওয়্যারলেস চার্জিংয়ের সুবিধা। এ
প্রযুক্তিতে তারের সংযোগ ছাড়াই গাড়ির শক্তি নিয়ে চার্জ হবে স্মার্টফোন।
বিল্ট ইন রাউটার থাকায় গাড়িজুড়ে ওয়াই-ফাই হটস্পট সুবিধা পাওয়া যায়।
বৈদ্যুতিক চার্জিং
জলবায়ুর পরিবর্তন মানুষকে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারের দিকে উদ্বুদ্ধ করছে।
বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারও বাড়ছে প্রতিদিন। টেসলা মটর এদিকে সবচেয়ে এগিয়ে।
তবে অন্যান্য ব্র্যান্ডও ইলেকট্রিক গাড়ির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এখন একবার
চার্জিংয়ে একটি গাড়ি ২০০ কিলোমিটার যেতে পারে। বিশ্ববিখ্যাত অডি, পোরশে,
ভক্সওয়াগন, ভলভো ও ফোর্ড সবাই ঘোষণা দিয়েছে ২০২০ সালের মধ্যে তারা সম্পূর্ণ
ইলেকট্রিক কার তৈরি করবে।
নাইট ভিশন
রাতে গাড়ি চালানো দিনের তুলনায় কঠিন। অন্ধকারের পাশাপাশি ঘুমের ঝোঁকও
সমস্যা। এ সমস্যার প্রযুক্তিগত সমাধান দিচ্ছে অডি। নতুন গাড়িগুলোতে তারা
নাইট ভিশন প্রযুক্তি যুক্ত করছে, যা ড্রাইভারের চোখ এড়িয়ে যাওয়া খানাখন্দ
বা সামনে থাকা গাড়ি সম্পর্কে ড্রাইভারকে সতর্ক করবে।
সেমি-অটো ড্রাইভিং সিস্টেম
বর্তমান পরিবহনব্যবস্থা সম্পূর্ণ চালকবিহীন গাড়ি সমর্থন করছে না। তবুও
অনেক প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করে যাচ্ছে এ ধরনের গাড়ি বানানোর। টেসলা ও
মার্সিডিজ বেঞ্জ এদিক থেকে এগিয়ে। বর্তমানে টেসলার প্রায় সব গাড়ি ও
মার্সিডিজের কিছু গাড়িতে ‘ড্রাইভ পাইলট’ নামে একটি প্রযুক্তি যুক্ত আছে।
এই প্রযুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ি চালাতে সক্ষম। চলতি বছর মার্সিডিজ
বেঞ্জের ই-ক্লাস একটি গাড়ি ড্রাইভার ছাড়া ঘণ্টায় ১৩০ মাইলে চলে আলোচনায়
আসে। প্রায় একই ধরনের আরেক সুবিধা হচ্ছে ‘ড্রাইভ পাইলট ডিস্ট্রনিক’। এর
কাজ হচ্ছে সামনের গাড়িকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে অনুসরণ করা।
চালকবিহীন গাড়ি প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন হলেও হুইল থেকে হাত সরানোর সময়
এখনো আসেনি। এসব ফাংশন বর্তমানে শুধু নিরাপদ ড্রাইভিং করার ক্ষেত্রে
সহায়তা করতে পারে।
সেলফ পার্কিং
সেলফ ড্রাইভিংয়ের সঙ্গে আরেকটি সুবিধা অনেক গাড়িতে যুক্ত হচ্ছে—সেলফ
পার্কিং। বিএমডাব্লিউ সেভেন সিরিজ, টেসলা, মার্সিডিজ-ই ক্লাস গাড়িতে এই
প্রযুক্তি আছে। মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করা এবং
পার্কিং থেকে গাড়ি বের করা যাবে। যদিও এটি এখনো বাইরের পার্কিংয়ে ব্যবহার
করার মতো স্মার্ট নয়, তবে নিজের পার্কিংয়ে গাড়িটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য
এটি একটি চমৎকার প্রযুক্তি।
জরুরি ব্রেক প্রযুক্তি
ধরুন, গাড়ি চালাতে চালাতে ড্রাইভারের ঝিমুনি ধরেছে, আর তখনই হঠাৎ সামনে
পড়েছে একটি গাড়ি, যা ড্রাইভারের চোখ এড়িয়ে গেছে। তখন গাড়ি নিজেই ব্রেক
করবে। এটিকে বলে অটোমেটিং ইমার্জেন্সি ব্রেকিং প্রযুক্তি। যা ২০১৫ সাল
থেকে নতুন গাড়িগুলোতে যুক্তি হচ্ছে। এটি একটি নিরাপত্তা ফিচার।
কেমন হতে পারে ভবিষ্যতের গাড়ি
ভবিষ্যতে গাড়ি কেমন হতে পারে তা বুঝতে হলে তাকাতে হবে কী কী উদ্ভাবন
চলছে এখন প্রযুক্তির জগতে। বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স জায়গা করে
নিচ্ছে। আর প্রাইভেট কার নির্মাতাদের লক্ষ্য সম্পূর্ণ অটোমেটিক কার।
অর্থাৎ সম্পূর্ণ অটোমেটিক ড্রাইভিং গাড়ি বানানোর জন্য আর্টিফিশিয়াল
ইন্টেলিজেন্স, জিপিএস, ক্যামেরা, ব্লুটুথ, ওয়াই-ফাই, দ্রুতগতির ইন্টারনেট
সব কাজ করবে একসঙ্গে। আপনার চালানো থেকে গাড়ি নিজেই শিখবে আর একদিন
সম্পূর্ণ আপনার মতোই ড্রাইভ করবে। সেই সঙ্গে ভয়েস কন্ট্রোল তো যুক্ত
হচ্ছেই। অর্থাৎ গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কথা বলেই।
সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন সুশৃঙ্খল সারিবদ্ধ গাড়ি দেখা যাবে
রাস্তায়, যা চালাতে দরকার হবে না ড্রাইভার। হবে না লেন পরিবর্তন বা
ট্রাফিক আইনের লঙ্ঘন।
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন